যশোর নামের ইতিকথা:: Naming History of Jessore

যশোর নামের ইতিকথা
Naming History of Jessore


 
যশোর শহরের নাম ইতিহাসের উত্থান পতনের সঙ্গে সঙ্গে কালে কালে বদল হয়েছে। মাথাভারী সব পন্ডিত আর গাবেষক এই শহরের নামের উৎপত্তি আর বিবর্তন নিয়ে শুনিয়েছেন বিচিত্র সব গল্প কাহিনী। বেশিরভাগ লোকের মত যশোর হলো যশোর শব্দের অপভ্রংশ। কারও মতে এই শহরের নাম জসর। কারও কারও মতে যশোর নামটি অতি প্রাচীন। নামটি মহাভারতীয় যুগে। কেউ বলেছেন, নামটি মিসরীয়।

যশোহর থেকে যশোর তত্ত্বটি বেশি প্রচলিত। তাদের মতে, রাজা প্রতাপাদিত্য বঙ্গের রাজধানী গৌড়ের যশ হরণ করে রাজধানীর নাম রাখেন যশোহর। কিন্তু এ তত্ত্ব ইতিহাস মিশ্রিত নয়। মোগল সম্রাট জাহাঙ্গীরের আসলে বাংলার বারো ভুইয়ার অন্যতম প্রতাপাদিত্য বিদ্রোহ করেছিলেন মোগল আধিপত্যের বিরুদ্ধে। বিশাল এক নৌ-বাহিনী গড়ে সুন্দরবনের অভ্যন্তরে সুরক্ষিত রাজধানী স্থাপন করেছিলেন ঈশ্বরীপুরে। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলায় যশোরেশ্বরীপুর বা ঈশ্বরীপুর ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে আজও। যশোর শহর থেকে যশোরেশ্বরী পূরের দূরত্ব প্রায় অর্ধশত মাইল। তাই, ভিন্ন মতালম্বীদের বিশ্বাস, যশোর নামটি যশোহর নামের অপভ্রংশ নয় কিছুতেই।

স্যার আলেকজান্ডার কানিংহাম ভিন্ন ব্যাখ্য দিয়েছেন। তার মতে, এই শহরের নাম জসর। শব্দটি আরবি। অর্থ সেতু বা সাকো। এই অঞ্চলে ছিল অনেক শাখা বা উপনদী। ভৈরব নদের দুই তীরে গড়ে উঠা শহরটি সংযুক্ত ছিল সাকো দিয়ে। তাই শহরের নাম জসর। অধিকাংশ মানুষের  ধারণা, কানিংহামের জসর নামও ইতিহাসাশ্রিত নয়।

গাঙ্গেয় ব-দ্বীপে দক্ষিণাঞ্চলকে প্রাচীনকালে বলা হতো উপবঙ্গ। ভাগীরথ থেকে পদ্মা- মেঘনার মধ্যবর্তী বিস্তৃর্ণ অঞ্চলকে বলা হতো সমতট। সমতটের ছিল বহু উপরিভাগ। তার একটা লাটদ্বীপ। লাটদ্বীপ ছিল অনেক ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র চর বা দ্বীপ। তার একটির নাম মুড়লী, অর্থ উচু স্থান। মুড়লী ছিল লাটদ্বীপের রাজধানী। গাঙ্গেয় ব-দ্বীপের আরেক নাম ছিল বকদ্বীপ। তার অপভ্রংশ বকচর।  মুড়লীর পাশেই আছে বকচর মৌজা। সেন ও পাল রাজত্বের সময় বকদ্বীপ বাগড়ী নামে পরিচিতি লাভ করে। বৌদ্ধ যুগে বলা  হতো বগ্‌দী। আদিম অধিবাসীরা ছিল অনার্য।  চীনা পরিব্রাজক হিয়েন সানের ভ্রমণকাহিনীতে সমতটে প্রায় ১০০ বৌদ্ধ সংঘারামের উল্লেখ আছে। মুড়লী ছিল তেমনই একটি সংঘারাম এবং যশোর রাজ্যের রাজধানী।

কিন্তু মহাভারতীয় কাহিনীতে মুড়লীর নাম যশোর। আর্যরা সম্ভবত খ্রিষ্টের জন্মের ২০০ বছর আগে উপবঙ্গে আসে। প্রাচীন সব ভৌগলিক বৃত্তান্তে এবং মানচিত্রে মুড়লীর উল্লেখ আছে। তন্ত্রচুড়ামণিতে সুস্পষ্ট উল্লেখ আছে যে যশোর চণ্ডভৈরবের তীরে অবস্থিত। তবে কি আর্যরা  মুড়লীর নতুন নাম দিয়েছিল যশোর? এই ধারণাই বহু যুগ ধরে প্রচলিত এ দেশে।

কিন্তু ভিক্ষু চমনলাল সাম্প্রতিক এক গবেষণাগ্রন্থে বলছেন, 
Zasor নামটি অভারতীয়। তার মতে, Zasor শব্দটি মিশরীয়। ইতিহাসের  বহু কাহিনী উদ্ধার করে চমনলাল বলছেন প্রায় সাড়ে তিন হাজার বছর আগে মিশরীয়রা বঙ্গে বসতি স্থাপন করে। ভৈরব নদীর তীরে গড়ে তোলে এক সমৃদ্ধ বাণিজ্যকেন্দ্র, নাম দেয় Zasor । এই অনুমান সঠিক হলে আর্যরা এখানে আসার  বহুকাল আগে থেকেই Zasorনামটি  বেশি পছন্দ করে থাকবে।

প্রাচীন গ্রিক এবং মিসরীয় গ্রন্থেও এ অঞ্চলের কথা উল্লেখ আছে। প্রাচীন মিসরীয় পন্ডিত চলেমী উপবঙ্গকে বলেছেন, গঙ্গারেজিয়া বা গঙ্গারেড়ি, সংস্কৃত ভাষায় গঙ্গাঋদ্ধি। দ্বিগঙ্গা ছিল গঙ্গাঋদ্ধির রাজধানী। গ্রিক বীর আলেকজান্ডারের ভারত অভিযানকালে গঙ্গাঋদ্ধির রাজা ছিলেন মহীপাল। তার বিশাল হস্তিবাহিনীর কাহিনী শুনে সম্রাট আলেকজান্ডারের বাহিনীর মধ্যে সৃষ্টি হয় মহাত্রাস। সিন্ধুপার থেকেই আলেকজান্ডার ফিরে যেতে বাধ্য হন স্বদেশাভিমুখে।

সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে খান জাহান আলী উপবঙ্গে আসেন। তিনি প্রথম যাত্রা বিরতি করেন যশোর শহর থেকে মাইল দশেক উত্তর-পশ্চিমে, বারো বাজারে। বারোজন আউলিয়ার স্মৃতি বিজড়িত বারোবাজারে নির্মিত হয়েছিল বতু অট্টালিকা, বেশ কয়েকটি মসজিদ। অনেক বড় দীঘি খনন করেছিলেন তিনি। পাশেই নির্মাণকরে মুরাগড় দুর্গ। বারোবাজার থেকে এসে তিনি অবস্থান নেন যশোরে। ফার্সি শব্দ কসবা যোগ করে নতুন নামকরণ করেন মুড়লী কসবা বা কসবা যশোর। কসবা কোনো নাম নয়, এটি বিশেষণ। ফার্সি ভাষায় কসবা অর্থ বাজার বা শহর। মুসলিম শাসনামলে এবং  ইসলাম প্রচার কেন্দ্র হিসেবে মুড়লী কসবা খ্যাতিলাভ করে।

আরও দক্ষিণে বাগেরহাট অভিমুখে যাত্রাকালে খান জাহান আলী এখানে তার দুজন প্রতিনিধি গরীব শাহ এবং বাহরাম শাহকে রেখে যান। মুড়লী- কসবা থেকে এই দুজন বুজুর্গ ইসলাম প্রচার করেন। এই দুজন বুজুর্গ যশোর শহরেই চিরনির্দায় শায়িত কারবালায়।

অন্যদিকে শহরের দক্ষিণ- পূর্ব প্রান্তে মুড়লীতে দানবীর হাজি মোহাম্মদ মুহসিন উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ইমামবাড়া। ধর্মীয় শিক্ষাদান ছাড়াও মানুষের কল্যাণার্থে তিনি তার সব বিষয় সম্পত্তি দান করে গেছেন।

বাংলাদেশে যে কটি নাম ইতিহাস, ভুগোল, মানচিত্র এবং উপখ্যানে পাওয়া যায় মুড়লী যশোর তার মধ্যে অন্যতম। এখানে হিন্দু বৌদ্ধ মুসলিম ইউরোপীয় সভ্যতার অপূর্ব মিলন ঘটে। মুড়লীতে প্রতিষ্ঠিত দেবালয়সমূহ কালে গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। মধ্যযুগে মুড়লীতে ভূগর্ভে নির্মিত হয়েছিল সুরক্ষিত কেল্লা। মাটির নীচে আজও চাপা পড়ে আছে সে কেল্লা। খুলনা-ঢাকা জাতীয় মহাসড়কের পাশে আজও অস্তিত্ব ঘোষণা করছে জগন্নাথদেবের মন্দির আর হাজি মুহসিনের ইমামবাড়া। সম্প্রতি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ ইমামবাড়া সংরক্ষণের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।

কোম্পানী এ দেশে জেলাভিত্তিক প্রশাসন গড়ে তোলে। সমগ্র বাংলাকে আট প্রেসিডেন্সী জেলার ভাগ করে নিয়োগ করা হয় জেলা কালেক্টর। এই নতুন প্রশানিক কাঠামোতে প্রাচীন যশোর রাজ্য পরিণত হয় বিশালায়তনিক যশোর জেলায়। জেলা সদর এই যশোর শহর। উত্তর-পূর্ব পদ্মা এবং মধুমতি আর পশ্চিমে ইছামতি বরাবর দক্ষিণে বঙ্গেপসাগর পর্যন্ত বিস্তির্ণ ভূভাগ অন্তর্ভূক্ত হয় যশোর জেলার। হান্টার পল্লীবালার ইতিহাসে যশোরকে বর্ণনা করেন শিক্ষা দিক্ষায় অগ্রসর একটি জেলা হিসেবে। তারই পাশপাশি তিনি বর্ণনা করেন নরবলির মতো আদিম ব্যবস্থারও।

তন্ত্রচুড়ামনির চন্ডভৈরব এখন মৃতপ্রায়। আমাদের জাতীয় ইতিহাসের স্বর্ণোজ্জ্বল অধ্যায়গুলো মসিলিপ্ত। নির্মম বিশ্লেষণে সেই বিস্মৃত প্রায় ইতিহাসকে পুর্ণমূল্যায়ন করা প্রয়োজন। যশোরের বুকের নিচে হারিয়ে গেছে তিন হাজার বছরের সমৃদ্ধ প্রাচীন নগরী মুড়লী। খানজাহান আলীর কসবা কোনোমতে টিকে আছে। পুরাতাত্ত্বিক গবেষণার মাধ্যমে হয়তো উদ্ধার করা সম্ভব মুড়লী কসবার ঐতিহ্যমন্ডিত এক বিস্মৃত প্রায় ইতিহাস।
https://www.facebook.com/mehedihasan.sagor.121
MD. MEHEDI HASAN SAGOR


মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

HISTORY OF KHULNA

Amazing Historical place Godkhali, Jhikargacha, Jessore

HISTORY OF RAJSHAHI